কুরআনে নারী পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ

কুরআনে নারী পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ

 কুরআনে নারী পুরুষ উভয়কেই দৃষ্টি অবনত রাখার নির্দেশ




ইসলাম মানবজাতির প্রাত্যহিক আদর্শ জীবনব্যবস্থা। মানুষের চলন-বলন থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের অনিন্দ্য সুন্দর বিধিবিধান ও আদর্শ রয়েছে। যা পালনে মানুষের ইহকাল এবং পরকাল শান্তিতে কাটবে। সমাজে ছড়াবে না অশান্তির বীজ। পথেঘাটে হয়রানি হবে না মা বোন। ইজ্জত-আবরু হরণ হবে না মস্তিষ্কবিকৃত আত্মভোলা মানুষের হাতে। নির্দিধায় চলতে পারবে প্রত্যেক নর নারী। এজন্য প্রয়োজন নারীদের পরপুরুষের সামনে চলাফেরার সময় পর্দাবৃত হয়ে বের হওয়া এবং পুরুষদের পরনারীদের দিকে দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকা।


কেননা আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরীফে ইরশাদ করেন, আপনি ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গকে হেফাজত করে এবং তাদেরকে যা প্রকাশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তাছাড়া অন্য কিছুর সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং যেন তাদের মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক অধিকারভ‚ক্ত বাঁদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারো কাছে তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে, তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।


হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা আন-নূর: ৩২) সূরা নূরের একত্রিশ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মুমিন পুরুষদের দৃষ্টি সংযত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বত্রিশ নং আয়াতে নারীদের প্রতি অর্থাৎ ঈমানদার নারীদের দৃষ্টি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি মুমিন পুরুষদেরও দৃষ্টি অবনমিত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। মুফাস্সিরগণ দৃষ্টি নত রাখার অর্থ করেছেন, দৃষ্টিকে এমন বস্তু থেকে ফিরিয়ে নেয়া যে বস্তু দেখা শরীয়তে নিষিদ্ধ ও অবৈধ। এমনিভাবে ইবনে কাসীর এবং ইবনে হাইয়্যান (রহ.) এর তফসীর করেছেন বেগানা নারীর প্রতি খারাপ নিয়তে দেখা হারাম এবং বিনা নিয়তে দেখা মাকরুহ এ বিধানটি এর অন্তর্ভূক্ত। কোন নারী অথবা পুরুষের গোপনীয় অঙ্গের প্রতি দেখাও এর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হবে। এছাড়া কারো গোপন তথ্য জানার জন্য তার গৃহে উঁকি মেরে দেখা এবং যেসব কাজে দৃষ্টি ব্যবহার করা শরীয়ত নিষিদ্ধ করেছে, সেগুলো এর অন্তর্ভুক্ত। যৌনাঙ্গ সংযত রাখার অর্থ এই যে, কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার যত পন্থা আছে, সবগুলো থেকে যৌনাঙ্গকে সংযত রাখা।


চোখ মহান আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত। মানুষের জীবনযাপনে চোখের ভূমিকা অতুলনীয়। আর এ চোখ কিভাবে ব্যবহার করতে হবে—মহান আল্লাহ সেটাও আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। চোখের নিষিদ্ধ ব্যবহার ইহকালীন ও পরকালীন ক্ষতির কারণ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবীজি (সা.) বলেছেন, চোখের জিনা হলো দেখা, জিহ্বার জিনা হলো কথা বলা আর কুপ্রবৃত্তি কামনা ও লালসা সৃষ্টি করে এবং যৌনাঙ্গ তা সত্য অথবা মিথ্যা প্রমাণ করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬২৪৩)


 

দেখা ও কথা বলা ব্যভিচারের প্রথম ধাপঃ

আল্লামা খাত্তাবি (রহঃ) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘দেখা ও কথা বলাকে জিনা বলার কারণ এই যে দুটোই প্রকৃত জিনার ভূমিকা—জিনার মূল কাজের পূর্ববর্তী স্তর। কেননা দৃষ্টি হচ্ছে মনের গোপন জগতের উদ্বোধক। জিহ্বা হচ্ছে বাণীবাহক। আর যৌনাঙ্গ হচ্ছে বাস্তবায়নের হাতিয়ার—সত্য প্রমাণকারী।’ (মাআলিমুস সুনান : ৩/২২৩)

 

উন্মুক্ত দৃষ্টি নৈতিক পতনের মুখে ঠেলে দেয়ঃ

ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) লিখেছেন, ‘দৃষ্টিই যৌন লালসা উদ্বোধক। কাজেই এ দৃষ্টির নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ মূলত যৌনাঙ্গেরই সংরক্ষণ। যে ব্যক্তি দৃষ্টিকে অবাধ, উন্মুক্ত ও সর্বগামী করে সে নিজেকে নৈতিক পতন ও ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। মানুষ নৈতিকতার ক্ষেত্রে যত বিপদ ও পদস্খলনেই নিপতিত হয়, দৃষ্টিই তার মূল কারণ। কেননা দৃষ্টি প্রথমত আকর্ষণ জাগায়। আকর্ষণ মানুষকে চিন্তা বিভ্রমে নিমজ্জিত করে। আর এ চিন্তাই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে লালসার উত্তেজনা। এ যৌন উত্তেজনা ইচ্ছাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে। আর ইচ্ছা ও প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়ে দৃঢ় সংকল্পে পরিণত হয়। এ দৃঢ় সংকল্প অধিকতর শক্তি অর্জন করে বাস্তবে ঘটনা সংঘটিত করে। বাস্তবে যখন কোনো বাধাই থাকে না, তখন এ বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন না হয়ে কারো কোনো উপায় থাকে না।’ (আল-জাওয়াব আলকাফি : ২০৪)


পরস্ত্রীকে দেখা না-জায়েজঃ

আকস্মিকভাবে কারো প্রতি চোখ পড়ে যাওয়া আর ইচ্ছাক্রমে কারো প্রতি তাকানো সমান কথা নয়। প্রথমবার যে চোখ কারো ওপর পড়ে গেছে, তার মূলে ব্যক্তির ইচ্ছার বিশেষ কোনো যোগ থাকে না। কিন্তু পুনর্বার তাকে দেখা ইচ্ছাক্রমেই হওয়া সম্ভব। এ জন্যই প্রথমবারের দেখায় কোনো দোষ হবে না। তবে দ্বিতীয়বার তার দিকে চোখ তুলে তাকানো ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষত এ জন্য যে দ্বিতীয়বারের দৃষ্টির পেছনে মনের কলুষতা ও লালসা পঙ্কিল উত্তেজনা থাকাই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের দৃষ্টিতে পরস্ত্রীকে দেখা স্পষ্ট হারাম। তার মানে কখনো এ নয় যে, পরস্ত্রীকে একবার দেখা জায়েজ এবং এখানে তার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। আসলে পরস্ত্রীকে দেখা প্রকৃতপক্ষেই জায়েজ নয়। এ জন্যই কোরআন ও হাদিসে দৃষ্টি নত করে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একদা নবীজি (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো : পরস্ত্রীর প্রতি আকস্মিক দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে আপনার কী বিধান? তিনি বলেন, ‘তোমার চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নাও।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২১৪৮)


কুদৃষ্টির ক্ষতিঃ

একজন পুরুষের দৃষ্টিতে কোনো পরস্ত্রী অতিশয় সুন্দরী ও লাস্যময়ী হয়ে দেখা দিল। পুরুষ তার প্রতি দৃষ্টি পথে ঢেলে দিল প্রাণ-মাতানো মন-ভুলানো প্রেম ও ভালোবাসা। স্ত্রীলোকটি তাতে আত্মহারা হয়ে গেল, সেও ঠিক দৃষ্টির মাধ্যমেই আত্মসমর্পণ করল এই পরপুরুষের কাছে। এখন ভাবুন তো, এর পরিণাম কী? এর ফলে পুরুষ কি তার ঘরের স্ত্রীর প্রতি বিরাগভাজন হবে না? এই স্ত্রীলোকটি কি নিজ স্বামীর প্রতি অনাসক্ত ও আনুগত্যহীন হবে না? অবশ্যই হবে। এর ফলে উভয়ের পারিবারিক জীবনের গ্রন্থি প্রথমে কলঙ্কিত ও বিষজর্জর এবং পরে সম্পূর্ণরূপে ছিন্ন হতে বাধ্য। এর পরিণামই তো আমরা সমাজে দিন-রাত দেখতে পাচ্ছি।


দৃষ্টি হেফাজতের ফলে মহাবিজয়ঃ

হজরত উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা.) একবার সাহাবাদের নিয়ে অমুসলিদের দুর্গে হামলা করলেন। দুর্গ অবারোধ করে রাখলেন। অবরোধ দীর্ঘ হয়ে গেল। বিজয় হচ্ছিল না। যখন অমুসলিমরা দেখল, মুসলমানরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দুর্গ অবরোধ করে রেখেছেন। তখন তারা একটি ষড়যন্ত্র করল যে, আমরা মুসলমানদের বলব—আমরা দুর্গের দরজা তোমাদের জন্য খুলে দিচ্ছি। তোমরা শহরে প্রবেশ করো। ষড়যন্ত্র হলো, শহরের দরজা যে দিক দিয়ে খুলছিল, সে দিকে লম্বা বাজার ছিল। যার দুই পাশে দোকান ছিল। সেই বাজার শাহি মহলে গিয়ে শেষ হয়েছিল। তারা বাজারের দুই পাশে সুন্দরী নারীদের সাজিয়ে প্রত্যেক দোকানে একজন একজন বসিয়ে দিল। তাদের বলে দিল, যদি মুজাহিদরা তোমাদের সঙ্গে কোনো কিছু করতে চায় তাহলে তোমরা অস্বীকৃতি জানাবে না। যেহেতু তাঁরা কয়েক মাস যাবৎ নিজ বাড়ি থেকে দূরে। ভেতরে প্রবেশের পর হঠাৎ যখন সুদর্শন এবং সুসজ্জিত নারী দেখবে, তখন তাঁরা তাদের প্রতি আকৃষ্ট হবে, তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। আর আমরা পেছন দিক থেকে আক্রমণ করব।


তাঁদের যখন এ প্রস্তাব দেওয়া হলো, তখন উদায়বা ইবনে জাররাহ (রা.) ভাবলেন, এতক্ষণ পর্যন্ত এ লোকগুলো মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত ছিল। দরজা খুলছিল না। এখন হঠাৎ কী হলো যে তারা দরজা খোলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল এবং সৈন্যদের প্রবেশের অনুমতি দিয়ে দিল! এতে নিশ্চয়ই কোনো ষড়যন্ত্র আছে।


সুতরাং তিনি সৈন্যবাহিনীকে একত্রিত করে বয়ান দিলেন। বললেন, মহান আল্লাহর কৃতজ্ঞতা। তারা হাতিয়ার নামিয়ে ফেলেছে। আমাদের প্রবেশের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। আপনারা অবশ্যই প্রবেশ করবেন। কিন্তু আমি আপনাদের সামনে কোরআনে কারিমের একটি আয়াত তিলাওয়াত করছি। আপনারা এ আয়াত পড়তে পড়তে এবং এর ওপর আমল করতে করতে প্রবেশ করবেন। সে সময় তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, ‘কুল লিল-মুমিনা ইয়াগুদ্দু মিন আবছারিহিম ওয়া ইয়াহফাজূ ফুজূরাহুম, জালিকা আজকা লাহুম’ অর্থাৎ মুমিনদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে।’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৩০)


সুতরাং তাঁরা দুর্গে এভাবে প্রবেশ করলেন যে তাঁদের দৃষ্টি ছিল নিচু। তাঁরা পুরো বাজার অতিক্রম করলেন। শাহি মহল পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। কেউ ডানে বাঁয়ে চোখ উঠিয়ে দেখলেন না যে কী ফেতনা ওই দোকানগুলোতে তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে।

শুধু তাঁদের এ দৃশ্য দেখে অগণিত শহরবাসী মুসলমান হয়ে গেলেন। সুবহানাল্লাহ। (ইসলাহী খুতুবাত : ১৫/৯৮)


আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আমাদেরকে দৃষ্টি হেফাজত করার তৌফিক দান করুক। আমীন।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে