হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) এর জীবনী

হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) এর জীবনী

 হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ)




হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) একজন বিশিষ্ট অলী ছিলেন। ইনি হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর শাগরেদ এবং হযরত শাহ পরান (রহঃ)-এর পীরভাই ছিলেন। হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ)-এর বংশ বিবরণে যতটুকু জানা যায়, তিনি শেরে খােদা হযরত আলী (রহঃ) বংশধর ছিলেন। তাঁহার পূর্বপুরুষ ব্যবসা উপলক্ষে মক্কা শরীফ হইতে বাগদাদ চলিয়া যান। তিনি বাগদাদ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং শিক্ষা-দীক্ষাও অর্জন করেন বাগদাদ নগরীতে। হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর আধ্যাত্মিক প্রভাবে মুগ্ধ এবং আকৃষ্ট হইয়া তিনি তাঁহার নিকট এলমে মারেফাতের দীক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর যথাসময়ে তিনি হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর এক প্রধান সহচর হিসাবে তাহার সহিত সিলেটে আসেন।


শ্রেষ্ঠ অলীর কিছুদিনের সাহচর্যেই হযরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (রহঃ) কামালিয়াতের উচ্চাসনে আরােহণ করিলেন। তখন হযরত শাহজালাল (রহঃ) তাহাকে দাওয়াতে দ্বীনের কাজে লাগাইয়া দিলেন। পীরের নির্দেশ মত ধর্ম প্রচারের কাজে নানাস্থানে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি মােস্তফাপুরে (বর্তমানের মৌলভীবাজার) আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলা বাহুল্য যে, উক্ত স্থানটির মােস্তফাপুর নামকরণ তাহার নিজের নামের দ্বারাই হইয়াছিল। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ঐস্থানেই ছিলেন। এস্থানে থাকিয়া বহু লােককেই তিনি খাটি ধর্মালােকে আনয়ন করিয়াছেন। ঐ সময়ে ত্রিপুরা রাজ্যের অধীনে বর্ষিজুড়া নামে একটি পার্বত্য এলাকা ছিল। সেখানে চন্দ্র নারায়ণ নামে এক সামন্ত রাজা রাজত্ব করিতেন। রাজা অত্যন্ত দাম্ভিক এবং উচ্চাভিলাসী ছিলেন। হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) যে স্থানটিতে বসিয়া ধর্ম প্রচার করিতেন,


তাহা রাজা চন্দ্র নারায়ণের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্থানটি স্থায়ী বসবাস এবং ধর্ম প্রচারের জন্য নানাদিক দিয়া যথেষ্ট অনুকূল ছিল। তজ্জন্য হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) সেখানে একটি স্থায়ী ধর্ম প্রচার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজা চন্দ্র নারায়ণের কাছে কিছু জমি চাহিলেন। কিন্তু রাজা তাহাতে সম্মত হইলেন না। রাজার মতামতের উপর রাজ্যের সবকিছু নির্ভরশীল। তাহার মতের বিরুদ্ধে কাহারও কিছু করিবার নাই সুতরাং হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) এ ব্যাপারে আর কোনরূপ উচ্চবাচ্য করিয়া আপন মনে ইসলাম প্রচারকার্যে নিয়ােজিত রহিলেন। রাজা চন্দ্র নারায়ণের রাজকার্যও যথারীতি স্বাভাবিকভাবে চলিতেছিল। কিন্তু সহসা রাজার সম্মুখে একটা বিপদ উপস্থিত হইল। কোথা হইতে একটি ভীষণ হিংস্র ব্যাঘ্র আসিয়া রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় দারুণ উৎপাত শুরু করিল। প্রতিরাত্রেই অন্ততঃ দুই একজন করিয়া লোক বাঘের শিকার হইতে লাগিল। বাঘটি কবে কাহার সর্বনাশ করে, সে কথা বলা যায় না। সমস্ত


এলাকা জুড়িয়া একটা সন্ত্রাস সৃষ্টি হইল। হিংস্র বাঘটির ভয়ে লোকজন একেবারে ফ্রিয়মান হইয়া পড়িল। সকলেরই মনে এই ভাবনা যে, সে না জানি কবে কাহার ঘরে প্রবেশ করিয়া কাহাকে কোনদিন ধরিয়া নিয়া যায়। মানুষ এখন আর ঘর হইতে তেমন বাহির হয় না। পথে ঘাটে লােক চলাচল একেবারে নাই বলিলেও চলে। সবাই একত্র হইয়া বাঘটিকে মারিবার চেষ্টা করিবে, এমন সাহস লােকদের হইল না। তাহারা দলে দলে রাজার নিকট নালিশ করিল যে, বাঘের উপদ্রব বন্ধ না করিলে বাধ্য হইয়া তাহাদের এদেশ ছাড়িয়া যাইতে হইবে। বলাবাহুল্য, কিছু কিছু বেশী ভীত লোক ইতিমধ্যে অন্যত্র চলিয়াও গিয়াছে।


রাজা ভীষণ সমস্যায় পড়িয়া গেলেন। প্রজাদের এ দুরবস্থার সুরাহা করিতে না পারিলে যে তাহার রাজত্ব করাই বৃথা। প্রজাপালন ও প্রজার দুঃখ-কষ্ট নিবারণই হইল রাজধর্ম। তাহা রক্ষা করিতে না পারিলে যে রাজার কলঙ্ক ও দুর্ণাম অনিবার্য। এ কতা চিন্তা করিয়া রাজা এ বিষয়টির দিকে বিশেষভাবে মনােনিবেশ করিলেন।অচিরেই সেনা বিভাগের প্রতি নির্দেশ হইল, বাঘটিকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া হত্যা করিয়া ফেলা হউক।


নিদের্শ অনুযায়ী বহুসংখ্যক সৈন্য-সামন্ত অস্ত্র-শস্ত্র লইয়া ব্যাঘ্রের যোজে বাহির হইয়া পড়িল। কিন্তু কি আশ্চর্য বাঘটি এমনভাবে আত্মগােপন করিল যে, তাহাকে কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। কিন্তু সৈন্যগণ সন্ধ্যায় ফিরিয়া আসিবার পর সেই রাত্রেই বাঘটি আবার লােকালয় হইতে কয়েকটি লােকের প্রাণ সংহার করিল। এ কথা প্রকাশ হইলে পরদিন আবার সেনাগণ বাঘের তালাশে বাহির হইয়া পড়িল। গভীর জঙ্গল, ঝােপ-ঝাপ সকল স্থান খুঁজিয়া তন্ন তন্ন করা হইল কিন্তু বাঘের সন্ধান পাওয়া গেল না। সারাদিন ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া সৈন্যগণ প্রত্যাবর্তন করিল। গভীর রাত্রে ব্যাঘ্র বাহির হইয়া আবারও কতিপয় প্রাণ বিনষ্ট করিল।


মােটকথা, বাঘের উৎপাত বন্ধ তাে করা গেলই না; বরং আরও বাড়িল। এই ব্যাঘ্র-সমস্যার ভিতরে আরও একটি নূতন সমস্যার সৃষ্টি হইল। প্রত্যুষে প্রাত্যহিক কাজকর্ম সারিয়া রাজা রাজদরবারে গিয়া রাজাসনে উপবেশন করিবেন ঠিক এই মুহূর্তে এক বিস্ময়কর ঘটনা দেখিয়া তিনি ভয়ে অস্থির হইয়া উক্ত আসনের নিকট হইতে দূরে ছুটিয়া গেলেন। রাজাসনের উপরে একটি ভয়ানক বিষধর সর্প বিড় পাকাইয়া বসিয়া ফণা উঁচু করতঃ ফোস ফোস করিতেছে।বিপদের উপরে আর এক মহাবিপদ। একদিকে ব্যাঘ্র আর একদিকে সর্প এমন দুর্বিপাক কে কবে কোথায় দেখিয়াছে? সভাসদগণ সাপটিকে সিংহাসনের উপর হইতে তাড়াইয়া দিতে বহু চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সাপ কোন কিছুতেই আসন ছাড়িয়া না। বরং তাহাকে তাড়াইবার চেষ্টা করিতে গেলে সে আরও অধিক রুদ্র মূর্তি ধারণ করিয়া অধিকতর আওয়াজে ফোস ফোস করিতে লাগিল। তাহার অবস্থা দেখিয়া তাহার শরীরে আঘাত করার সাহস কাহারও হইল না। এমনি ধরনের অবস্থায় রাজা কি যে করিবেন তাহা স্থির করিতে পারিলেন। । তাহার সভাসদেরাও তাহাকে কোন সৎ পরামর্শ প্রদানে সক্ষম হইলেন না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় রাজা ভাবিতে লাগিলেন, কি কারণে এমন হইল? এইরূপ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে কি কারণ থাকিতে পারে, তাহা উদঘাটন করা যায় কি না তদ্বিষয়ে তিনি চিন্তামগ্ন হইলেন।


হঠাৎ তাহার মনে পড়িয়া গেল সেই মুসলিম দরবেশের কথা যিনি তাহার নিকট সামান্য যমিন চাহিয়াছিলেন। অথচ তিনি তাঁহাকে তাহা দেন নাই। ঘটনাটি স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে তাহার মনে জাগিয়া উটিল, এইসব ঘটনা

যাহা কিছু ঘটিতেছে, ইহা সবই সেই দরবেশের কারসাজি। ব্যাঘ্র ও সর্প নিশ্চয়ই সেই লােকটিই পাঠাইয়াছে। অতএব তাঁহার সহিত সমঝােতা স্থাপন করা একান্ত প্রয়ােজন। নতুবা তাহার গত্যন্তর নাই। মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া রাজা চন্দ্র নারায়ণ উক্ত দরবেশ হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হইলেন এবং তাহার নিকট সবিনয়ে বলিলেন, হুযুর! আপনি আমার মান-সম রক্ষা করুন ও আমাকে বিপদমুক্ত করিয়া দিন। আমি আপনার কাছে যে অপরাধ করিয়াছি হজ্জন্য করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করিতেছি। হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) দেখিলেন, হিন্দু রাজার মনােভাব পরিবর্তিত হইয়াছে। মুসলমানদের সাথে তাঁহার যে শত্রুতার মনােভাব ছিল, এইবার তাহা দূর হইয়াছে এবং সে শিক্ষাও কম পায় নাই। রাজার প্রতি তাঁহার দয়া হইল। সুতরাং তিনি তাহাকে বলিলেন, তুমি তােমার রাজ দরবারে গমন কর, আমি আসিতেছি।


তাহার কথামত রাজা স্বীয় দরবারে প্রত্যাবর্তন করিলেন এবং একটু পরেই হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তগ (রহঃ) রাজ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী সেই বাঘটিকে তলব করিলেন। অমনি বাঘটি আসিয়া মাথা নীচু করিয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল। তিনিবাঘটির পিঠে সওয়ার হইয়া রাজ দরবারে উপস্থিত হইলেন। উল্লেখ্য যে, দরবারস্থ রাজ সিংহাসনে তখনও পূর্বোক্ত সেই সাপটি বিড় পাকাইয়া ফণা উঁচু করিয়া ফোস ফোস করিতেছিল। রাজা সিংহাসনের কাছে না গিয়া বহুদুরে দাঁড়াইয়া রহিলেন। হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) দরবারে পৌছিয়া দূর হইতেই সাপটিকে ইশারায় ডাকিলেন। অমনি সে সিংহাসন হইতে নামিয়া ধীরে ধীরে তাহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইল এবং বাঘের পা বাহিয়া উঠিয়া হযরতের হাতের নাগালে পৌছিল। তিনি সাপটিকে ধরিলেন। অমনি সাপটি চাবুকে পরিণত হইল। এই সব ঘটনা স্বরং রাজা, তাঁহার সভাষদ এবং সমবেত অন্যান্য বহু লােক চোখের সামনে প্রত্যক্ষ করিয়া বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গেল।


তাহারা প্রত্যেকেই অনুভব করিল যে, এই মুসলমান দরবেশ কোন সাধারণ লােক নন। ইনি স্বয়ং স্রষ্টার বিশেষ প্রিয় ও ঐশীসম্পন্ন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।রাজা চন্দ্র নারায়ণ তাহার প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধার বিগলিত হইয়া গেলেন এবং তাহার বসবাসের জন্য নিজের বাড়িটি তাহাকে দান করিলেন। উপরন্তু তিনি প্রস্তাব দিলেন যে, হে মাননীয় সাধু! যদি আপনি রাজী থাকেন, তবে আমি আমার বিবাহযােগ্যা সুন্দরী ও সর্বগুণান্বিতা কন্যাকে আপনার হাতে সােপর্দ করিতে চাই। হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ) রাজার প্রস্তাব কবুল করিলেন এবং রাজাদুহিতাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করাইয়া বিবাহ করিলেন। ইসলাম গ্রহণ করার পর রাজদুহিতার নামকরণ করা হইয়াছিল সালেমা খাতুন। রাজা চন্দ্র রায়ণ নিজের বাড়ি দরবেশ সাহেবকে প্রদান করিয়া নিজে নূতন বাড়ি নির্মাণ করতঃ তাহাতে বাস করিতে লাগিলেন।


রাজা চন্দ্র নারায়ণ হযরত সৈয়দ শাহ মােস্তফা (রহঃ)-কে মনেপ্রাণে ভক্তি-শ্রদ্ধা করিতে লাগিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন কি না তাহা জানা যায় নাই। হযরত শাহ মােস্তফা (রহঃ) রাজপ্রদত্ত বাড়িতে বসবাস করিয়াই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মােস্তফাপুর এবং তাহার চতুষ্পার্শ্বস্থ এলাকাসমূহে দ্বীনের দাওয়াতের কাজে মশগুল ছিলেন। তাহার মৃত্যুর পরে মােস্তফাপুরেই তাহাকে

দাফন করা হয়। সেখানে স্থাপিত তাঁহার পবিত্র মাযার শরীফ এখনও দেখা যায়।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে