হযরত কুতুবুল আউলিয়া (রহঃ) এর জীবনী

হযরত কুতুবুল আউলিয়া (রহঃ) এর জীবনী

হযরত কুতুবুল আউলিয়া (রহঃ)





হযরত কুতুবুল আউলিয়া (রহঃ)-এর আসল নাম শাহ ইলয়াস কুদুস (রহঃ) তিনি ছিলেন তরফ বিজয়ী হযরত সৈয়দ নাসীর উদ্দীন (রহঃ)-এর বংশােদ্ভূত লােক। ঘর গাঁও নামক গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

এই ব্যক্তি অবশ্য হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর প্রত্যক্ষ বা একেবারে সরাসরি শিষ্য ছিলেন না; বরং পরােক্ষ শিষ্য ছিলেন। তবে পরােক্ষ শিষ্য হইলেও শাহ জালাল (রহঃ)-এর সহিত তাহার আত্মিক এবং অধ্যাত্মিক সম্পর্ক কোন অংশেই প্রত্যক্ষ শিষ্যগণ অপেক্ষা কম ছিল না। এইজন্যই আমরা এখানে তাঁহার আলােচনাও পেশ করিলাম। 


মূলতঃ হযরত শাহ জালাল (রহঃ) তাহার অপূর্ব আলােক রশ্মি বিচ্ছুরণ ঘটাইয়া দিয়া গিয়াছিলেন, যুগযুগান্তর ধরিয়া তাহা অক্ষুণ্ন ছিল। কালের চক্র তাহা এতটুকু স্নান বা নির্বাপিত করিতে পারে নাই, এমনকি এতটুকুমাত্র ঘুনও ধরাইতে সক্ষম হয় নাই। ঐ আলােক রশ্মিই দুইটি উপায়ে হযরত শাহ ইলিয়াস কুদ্দুস (রহঃ)-এর অন্তরে প্রবেশ করিয়াছিল।


তাহার একটি হইল বংশীয় রক্তধারা। হযরত শাহ ইলিয়াস কুদ্দুস (রহঃ) সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। আর হযরত রাসূলে পাক (সাঃ)-এর পরে এই বংশের লােকেরা ধর্মপরায়ণতা ও পরহেজগারিতার দিক দিয়া সর্বদাই অগ্রগামী ছিলেন এবং এখনও আছে।


দ্বিতীয়টি হইল, হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর প্রত্যক্ষ শিক্ষাপ্রাপ্ত ও হাতে গড়া শিষ্য সৈয়দ নাসীর উদ্দীনের বংশানুক্রমিকভাবে যে রক্তধারা তিনি লাভ কখিরয়াছিলেন, তাহা অতি স্বাভাবিকভাবেই তাহার অন্তরে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছিল। অবশ্য এতদিন সুপ্তাবস্থায় ছিল। হঠাৎ একটি গটনার মধ্যদিয়া সেই সুপ্ত অনুপ্রেরণাই জাগ্রত আগ্নেয়গিরির রূপ ধারণ করিল।


ঘটনাটি এরূপ: হযরত শাহ ইলিয়াস কুদ্দুস (রহঃ)-এর পরিবারে একটি বাদী ছিল। একদা কি একটা কথা প্রসঙ্গে বাদীটি বলিয়া ফেলিল, "দিন তাে চলিয়া গেল। হযরত শাহ ইলিয়াস কুদ্দুস (রহঃ) নিকটেই ছিলেন। কথাটি তাঁহার অন্তরে এমনভাবে রেখাপাত করিল যে, তিনি আর স্থির হইয়া বসিতে পারিলেন না। অত্যন্ত চঞ্চল এবং অস্থির হইয়া পড়িলেন তিনি। সেই মুহূর্তেই বাড়ির বাহির হইয়া পড়িলেন। তাঁহার বাঁদর কথাটি বার বার স্মৃতিপটে উচ্চারিত হইতে লাগিল, 'দিন তাে চলিয়া গেল। ভীষণ এক আলােড়ন সৃষ্টি হইয়া গেল তাহার অন্তরে। ভাবনার সৃষ্টি হইল মনে। যায় যায়। এ জগতে কেন আসিয়াছিলাম, আর কিরলামই বা কি? দিন তাে চলিয়া গেল। সময় ফুরাইয়া আসিল একেবারে। পুঁজি তাে মােটেই জোগাড় হইল না। খরচই করিয়া গেলাম অথচ জমার তহবিল যে একেবারেই শূন্য।


ভাবিতে ভাবিতে হযরত সৈয়দ শাহ ইলিয়াস (রহঃ) সােজা এক জঙ্গলে চলিয়া গেলেন এবং সেই নির্জন জঙ্গলে বসিয়া ইবাদাতে মশগুল হইলেন। আহার-ন্দ্রিা বিসর্জন দিয়া শুধু ইবাদাতকেই পরিয়া নিলেন একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘকাল এইভাবে কাটাইবার পর আল্লাহর তাঁহার প্রতি সদয় হইলেন।তিনি কামালিয়াত হাসিল করিলেন।


কথিত আছে, একদিন অন্ধকার গৃহে তিনি আল্লাহ পাকের গভীর উপাসনায় মগ্ন ছিলেন। কিছুক্ষণ যাইতে না যাইতে চন্দ্রালােকের মত উজ্জ্বল একটি আলােক পিণ্ড হঠাৎ তাহার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। তাহাতে ঘরের অভ্যন্তর ভাগ আলোক উদ্ভাসিত হইয়া গেল।


যেদিন এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি সংঘটিত হইল, সেইদিন হইতেই তিনি কুতুবুল আউলিয়া বা অলীদের মধ্যমণি উপাধিতে ভূষিত হইলেন। আর যে স্থানটিতে এই ঘটনা ঘটিল, সেই স্থানটি আখ্যায়িত হইল চন্দ্রচুরি গ্রাম নামে। হযরত কুতুবুল আউলিয়া তথা হযরত শাহ ইলিয়াস (রহঃ) সত্যই যে অলীদের মধ্যমণি ছিলেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই। 

বাতেনী এলেমের সাধনার ক্ষেত্রে সমসাময়িক অলীদের মধ্যে তিনি সকলের উপরে ছিলেন। তিনি যখন নামায আদায় করিতে দাঁড়াইয়া যাইতেন, তখন তাহার পার্থিব অনুভূতি ও বাহ্যজ্ঞান সম্পূর্ণরূপে লােপ পাইত। তিনি যখন কোন কথা বলিতেন, তাহাতে আন্তরিক প্রভাব এত বেশী থাকিত যে, সেইকথা মহা পাপীর হৃদয়েও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করিত।


আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করিবারকালে তিনি যাবতীয় পার্থিব বিষয়বস্তু একেবারেই বিস্মৃত হইতেন। নেত্রযুগল হইতে অশ্রুর ঢল বহিতে থাকিত। মাতৃহারা সন্তান যেভাবে মাতাকে না পাইয়া ক্রন্দন করে, মুনাজাতের সময় হযরত শাহ ইলিয়াস (রহঃ)-ও দ্রুপই ব্যাকুলভাবে ক্রন্দন করিতেন। তাঁহার সেই ক্রন্দনে আল্লাহর আরশে কম্পন সৃষ্টি হইত। ফেরেশতাগণ সে ক্রন্দন দেখিয়া নীরবে তাকাইয়া থাকিত আর তাহার ভক্ত শিষ্যগণের মধ্যে কান্নার রােল পড়িয়া যাইত। পার্থিব দ্রব্যসামগ্রী বলিতে তাহার মাত্র তিন খণ্ড পাথর ছিল। তাহার এক খণ্ডে বসিয়া তিনি অজু করিতেন। এক খণ্ডের উপর দাঁড়াইয়া নামায পড়িতেন।


আর এক খণ্ডে বসিয়া তিনি পানাহার করিতেন। শুনা যায়, ঐ প্রস্তর খণ্ড্রয় নাকি তাহার জন্মস্থান ঘড় গাঁওয়ে এখনও সযত্নে বাক্ষিত আছে। আর ঘর গাঁওয়ের যে বাড়িতে তিনি বাস করিতেন, এখনও সে বাড়িটি পীরের বাড়ি বলিয়া অভিহিত হইতেছে। কুতুবুল আউলিয়ার প্রপৌত্রের নাম ছিল গদা হাসান। তিনি একজন শীর্ষস্থানীয় অলী ছিলেন। সাধনা জগতে তাহার যথেষ্ট সুখ্যাতি, সুনাম ছিল।

এইরূপ শুনা যায়, আরাকানের তৎকালীন মগ বংশীয় রাজা তাঁহার পূর্বপুরুষ সৈয়দ মূসা (রহঃ)-কে যে তরবারি খানা উপহার দিয়াছিলেন এবং যাহা বংশানুক্রমিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাহা এবং তাহার সাথে একটি অশ্ব বিখ্যাত যােদ্ধা শমসের গাজী কে দান করিয়া তিনি বলিয়াছিলেন, আমি এই তরবারী ও অশ্ব তোমাকে দান করিলাম। উহার দৈব শক্তির উসিলায় তুমি সর্বদাই বিজয়ী থাকিবে এবং শেষ পর্যন্ত চাকলাবাদের শাসনাধিকারও তােমার হস্তে আসিবে। বলাবাহুল্য যে, তাঁহার এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হইয়াছিল। সত্যই শমসের গাজী চাকলাবাদের রাজা হইয়াছিলেন।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে