হাদিস সংকলনের ইতিহাস

হাদিস সংকলনের ইতিহাস

হাদিস সংকলনের ইতিহাস





মহানবী (স.) এর জীবদ্দশায় সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (স.) হাদিস সমূহ অত্যন্ত আগ্রহসহকারে মুখস্ত করে স্মৃতিপটে সংরক্ষণ করতেন। আবার অনেকে মহানবী (স.) এর অনুমতি সাপেক্ষে কিছু কিছু হাদিস লিখেও রাখতেন। এভাবে রাসুলুল্লাহ (স.) এর আমলে স্মৃতিপটে মুখস্ত রাখার সাথে সাথে কিছু হাদিস লিখিত আকারে লিপিবদ্ধ ছিল। হযরত আলী(রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রা.), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা.), হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) প্রমূখ সাহাবিগণ কিছু কিছু হাদিস লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ব্যতীত আর কোন সাহাবী আমার চেয়ে বেশী হাদিস জানতেন না। কারণ, তিনি হাদিস লিখে রাখতেন আর আমি লিখতাম না ।

মহানবী (স.)-এর জীবদ্দশায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজ-কর্ম লিখিতভাবে সম্পাদন করা হতাে। বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা, সরকারি কর্মচারী এবং জনসাধারণের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত নির্দেশ দান করা হতাে। এতদব্যতীত রােম, পারস্য প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশসমূহের সম্রাটদের সাথে পত্র বিনিময়,ইসলামের দিকে দাওয়াত এবং বিভিন্ন গােত্র ও সম্প্রদায়ের সাথে চুক্তি ও সন্ধি লিখিতভাবে সম্পাদন করা হতাে। আর মহানবী (স.)-এর আদেশক্রমে যা লেখা হতাে তা হাদিস বলে পরিচিত। মহানবী (স.) এর মৃত্যুর পরে বিভিন্ন কারণে হাদীস সংকলন করা দরকার।  কুরআন মাজিদের সাথে হাদীসটি মিশ্রিত হওয়ার ভয়ে কোরআন পূর্ণ গ্রন্থে লিখিত না হওয়া পর্যন্ত হাদীস


লিপিবদ্ধ করতে কেউ সাহস পায়নি। কিন্তু প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এর আমলে কুরআন মাজিদ গ্রন্থাকারে লিখিত হলে সাহাবীগণ হাদিস লিপিবদ্ধ করার ব্যাপারে আর কোন বাধা আছে বলে অনুভব করেননি। হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ নাগাদ সাহাবী ও তাবিঈগণ প্রয়ােজন অনুসারে হাদিস লিপিবদ্ধ করেন। অতপর হিজরী প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে উমাইয়া খলিফা উমর ইবনে আব্দুল আযীয (রহ.)-এর আদেশে হাদিস সংগ্রহের জন্য মদিনার শাসনকর্তা আবু বকর বিন হাজমসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার শাসনকর্তা ও আলিমগণের কাছে এটি জারি করে বলেন যে, আপনারা মহানবী (স.)-এর হাদিস সমুহ সংগ্রহ করুন। কিন্তু সাবধান মহানবী (স.)-এর হাদিস ব্যতিত অন্য কোন কিছু গ্রহণ করবেন না। আর আপনারা নিজ নিজ এলাকায় মজলিস প্রতিষ্ঠা করে আনুষ্ঠানিকভাবে হাদিস শিক্ষা দিতে থাকুন। কেননা, তান গােপন করা হলে তা একদিন বিলুপ্ত হয়ে যায়।

এই আদেশ জারি হওয়ার পরে মক্কা, মদিনা, সিরিয়া, ইরাক এবং অন্যান্য অঞ্চলের হাদীস সংকলনের কাজ শুরু হয়।  উল্লেখ আছে যে বিশিষ্ট মুহাদ্দীদ ইমাম ইবনে শিহাব জুহরী হলেন হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনকারী সর্বপ্রথম।


কিন্তু তাঁর সংকলিত হাদিস গ্রন্থের বর্তমানে কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। এরপর ইমাম ইবনে জুরাইজ মক্কায়, ইমাম মালিক মদীনায়, আব্দুল্লাহ ইবনে ওহাব মিসরে, আব্দুর রাজ্জাক ইয়ামেনে, আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক খোরাসানে এবং সুফিয়ান ছাওরী ও হাম্মাদ ইবনে সালামা বসরায় হাদিস সংগ্রহে আত্মনিয়ােগ করেন। এ যুগের ইমামগণ কেবল দৈনন্দিন জীবনে প্রয়ােজনীয় হাদিসগুলাে ও স্থানীয় হাদিস শিক্ষা তিনি কেন্দ্রে পাওয়া হাদীস লিপিবদ্ধ করেছেন।  এদের কেউই হাদীসকে বিন্যাস হিসাবে রেকর্ড করেনি।  ইমাম মালিক রচিত মুওয়াত্তা গ্রন্থটি যুগের প্রথম ও সর্বাগ্রে খাঁটি হাদীস গ্রন্থ।  ইমাম মালিকের বই 'মুওয়াত্তা' হাদীস সংকলনের জন্য প্রচুর উত্সাহ জাগিয়ে তুলেছিল।  এটি হাদীস অধ্যয়নের ক্ষেত্রে মুসলিম আলেমদের প্রধান আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  ফলস্বরূপ, সারা দেশে হাদীস অনুশীলনের কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে।

ইমাম শাফিয়ী (রহ.) এর কিতাবুল উম্ম এবং ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের মুসনাদ গ্রন্থয় হাদিসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।


এর পর তৃতীয় হিজরী শতাব্দীতে বিভিন্ন মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর হাদিস সংগ্রহ করেন। তন্মোধ্যে বিখ্যাত হলেন ইমাম বুখারী (রহ.), ইমাম মুসলিম (রহ.) ইমাম আবু দাউদ (রহ.), ইমাম তিরমিযী (রহ.), ইমাম নাসাঈ (রহ.) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রহ.)। এদের সংকলিত হাদিস। গ্রন্থগুলাে হলাে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামি তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ এবং সুনানে ইবনে মাজাহ। এই ৬টা হাদিস গ্রন্থকে একত্রে  সিহাহ সিত্তাহ বা ৬টি বিশুদ্ধ গ্রন্থ বলা হয়।


উল্লেখিত আলােচনার প্রেক্ষিতে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, মহানবী (স.) এর জীবদ্দশায় যে হাদিস সমূহ প্রধানত সহাবীদের স্মৃতিপটে মুখস্ত ছিল তা ধীরে ধীরে লিখিত রূপ নেয় এবং আব্বাসীয় যুগে হাদিস লেখালেখির কাজ পরিসমাপ্ত হয়। (আর এটাই হলো হাদিস সংকলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।)

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে