হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর সংকিপ্ত পরিচিতি |হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী |

হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর সংকিপ্ত পরিচিতি |হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী |

 হযরত শাহ জালাল (রহঃ)




বংশ ও পিতা-মাতা: মক্কার ঐতিহ্যবাহী ও শ্রেষ্ঠ বংশ কুরাইশদের একটি শাখা ধনে-জনে শিক্ষা-দীক্ষায় ও মানে গৌরবে ৎকালে খুবই প্রসিদ্ধ ছিল। ধর্ম পালন, ন্যায় নীতি ও সততার আশ্রয় অবলম্বনে ঐ কোরাইশ শাখাটির বৈশিষ্ট ছিল। বংশের প্রাচীন ঐতিহ্য অনুসারে ইসলামােক্তর যুগের তারা প্রধানতঃ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকেই অর্থ উপার্জন করতেন। ঐ কোরাইশ শাখাটির বেশ কিছু পরিবার তাদের জন্মভূমি মকা ছেড়ে হেজাযের দক্ষিণ-পশ্চিম হতে মেনে চলে আসে, তাদের মধ্যে শায়খ মাহমুদ ছিলেন এক উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি। তিনি কিছুদিন ইয়ামেনে অবস্থান করার পর তার পরিবার পরিজন ও কতিপয় নিকটাত্মীয় সহ সেখান হতে তুরস্কে চলে যান এবং তথাকার কুনিয়া নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে গিয়ে বসতি স্থাপন করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, শায়খ মাহমুদ যখন ইয়ামেন হতে তুরস্ক গমন করেছিলেন তখন তিনি যদিও বিবাহিত ছিলেন, কিন্তু তার কোন সন্তান ছিলনা। তিনি নিজে যেমন মক্কায় আভিজাত কোরাইশ বংশোদ্ভূত ছিলেন, তেমনি তিনি বিবাহ করেছিলেন কোরায়েশ বংশীয়া এক শরীফ মহিলাকে। ও মহিলা নানাগুণে বিভূষিতা ছিলেন। সততা, সত্যবাদিতা, নম্রতা, পবিত্রতা প্রভৃতি শুনে তিনি তৎকালীন কোরাইশ মহিলাদের মধ্যে ছিলেন বৈশিষ্ট্যের অধিকারিনী। সর্বোত্নী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মহিলা বলে তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল।


সে যুগে বিভিন্ন মুসলিম রাজ্য ও এলাকাগুলোতে সীমান্ত এলাকায় বিধ্মীদের সাথে কোথাও বা সর্বাত্মক যুদ্ধ এবং কোথাও বা খন্ড যুদ্ধ লেগে ছিল। তবু সে সময় ইসলাম ধর্মের প্রচার কার্য সর্বস্থানেই কম-বেশী জারী ছিল। শায়খ মাহমুদ নিজেকে ইসলাম প্রচার কার্যে একনিষ্ঠভাবে নিয়ােজিত করেছিলেন। আর এ কাজের উপলক্ষ্যে বিভিন্ন সময় তাকে ধর্মীয় যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল। যুদ্ধের ময়দানে তিনি সব সময়ই অদ্ভুত বীরত্ব প্রদর্শন করতেন। ঈমানের জোশে বলীয়ান মাহমুদ শত্রু পক্ষের জন্য খ্যতির কারণ ছিলেন। এ কারণে সর্বক্ষেত্রেই তিনি প্রতিপক্ষের সাথে জয়লাভ করতেন। এ সুবাদে তিনি সমকালীন মুসলমানগণের নিকট অতিশয় ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।


হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর জন্ম: শায়খ মাহমুদ (রহঃ) ইয়ামেন হতে যখন সস্ত্রীক তুরস্কের কুনিয়া নামক ছােট শহরে এসে বসবাস আর করেন তখনও পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। বিবাহের পরে দীর্ঘদিন এভাবে কোন স্তান-সুতি লাভ না করায় শায়খ মাহমুদ দম্পতি পারিবারিক জীবনে সত্যিই একটি সন্তানেরঅভাব অনুভব করছিলেন। তারা এতদিনে কোন সন্তান-সন্তুতি লাত না করে সত্যিকারভাবেই খুবই অসুখী ছিলেন। এজন্য তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই অন্ততঃ একটি সন্তান লাভের জন্য আল্লাহর দরবারে নিয়তই প্রার্থনা করতেন। অচিরেই আল্লাহর দরবারে মাহমুদ দম্পতির করুণ মিনতি কবুল হল। শায়খ মাহমুদের স্ত্রী শীঘ্রই গর্ভে সন্তান ধারন করলেন। দেখতে দেখতে গর্ভকালীন নির্দিষ্ট সময় উত্তীর্ণ হয়ে গেল। শেষ মূহূর্তে শায়খ মাহমুদ স্ত্রী আকাশের চতুল্য অতুলনীয় সুন্দর একটি পুত্র সন্তান প্রসব করলেন। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানের রূপ দর্শন করে পিতা মাতার চক্ষু জুড়িয়ে গেল এবং তাদের অন্তরও ভরে গেল। 

আল্লাহর কৃপায় এমন সন্তান লাভ করে শায়খ মাহমুদ তাে নিজেকে ধন্যই মনে করলেন। কিন্তু তার স্ত্রী সম্ভবতঃ খুশী ও আন্দন্দিত হয়েছিলেন স্বামী অপেক্ষা আরও বেশী। কারণ বিবাহিত জীবনে সন্তান কামনা নারীরা পুরুষ অপেক্ষা অধিক করে থাকে। বাল্য কালেই হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর পিতা-মাতা মারা যান।


বাল্যকাল ও শিক্ষা দীক্ষাঃ আহমদ কবীর জননীহারা ভাগিনেটিকে প্রকৃত মানুষ করে গড়ে তােলার সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন। বিশেষতঃ সে যেন তার মাতা ও পিতার অভাব কোন দিক দিয়ে অনুভব করতে না পারে সে ভাবে তাকে সর্বরকম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে দিয়া প্রতিপালন করতে লাগলেন। বলা বাহল্য, তিনি তাকে নিজ সন্তান অপেক্ষা এতটুকু কম স্নেহ করতেন না। যার ফলে জালাল তার মাতৃ-পিতৃ অভাব একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। মামা আহমদ কবীর নিজে পরম ধার্মিক এবং একজন প্রধান আলেম ছিলেন। সুতরাং ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়ােজনীয় তাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন আর এজন্যই তিনি ভাগিনাকে উক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে তাকে সর্বপ্রথম আরবী ভাষার প্রাথমিক সবক দান করলেন। সাথে সাথে তাকে ধর্মীয় ইবাদত-বন্দেগীতে ব্যস্ত করার জন্য নামাযের আনুষ্ঠানিক বিষয়সমূহ উত্তমরূপে শিক্ষা প্রদান করে নামাযে দাঁড় করে দিলেন। মাত্র ছয় বৎসর 1. বয়সের কালে জালাল নিয়মিত নামায আদায় করতেন।


বালক জালাল জন্মসূত্রেই পিতার সমস্ত গুণের ধারক ছিলেন। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন পরম বিদ্যোৎসাহী অন্যদিকে ছিলন তেমনি অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন স্মরণশক্তির অধিকারী তার স্মরণ শক্তি এত প্রখর ছিল যে, একটি সবক তার মাত্র একবারের অধিক পড়ার প্রয়ােজন হত না। কোন কিছু তিনি কারও মুখ হতে একবার শুনলেই তা অক্ষরে অক্ষরে মনে থেকে যেত। কস্মিনকালেও তিনি তা বিশ্বৃত হতেন না। তার মামা ভাগিনার এ অপূর্ব গুণসমূহ প্রত্যেক্ষ করে আনন্দে ও আশায় উৎফুল্ হয়ে উঠেছিলেন এবং তার সম্পর্কে হৃদয়ের মধ্যে বিশেষ আশা পােষণ করে তাকে ইলেমের বিভিন্ন শাখা শিক্ষা প্রদানে আত্মনিয়ােগ করেন। জালালও দারুন পরিশ্রমী বালক ছিলেন। শিক্ষার্জনের ব্যাপারে তার এতটুকু মাত্র অবহেলা বা অমনােযােগ ছিল । তিনি কঠোর যত্ন ও সাধনার দ্বারা মাতুল প্রদত্ত সকল শিক্ষা মনে-প্রাণে আয়ত্ত করতে শুরু করলেন। এলেম বলতে কেবলমাত্র জাহেলী ইলেমই নয়, জাহেরী ইলম তাে তিনি শিখতেই লাগলেন। সাথে সাথে বাতেনী ইলেম তথা আধ্যাত্মিক ইলমও অর্জন করতে মনােনিবেশ করলেন। যে বাল্য বয়সে সকলে খেলাধুলা, চঞ্চলতা ও অমােদ-প্রমােদে মত্ত থাকে, সে বয়সে জালাল মানুষের প্রকৃত ভূষণ শিক্ষা লাভের জন্য আরাম, আয়েশ হারাম করে সাধনার গভীর সমুদ্রে ডুবে গেলেন।


হযরত শাহ জালাল (রহঃ)-এর শেষ জীবন: হযরত শাহ জালাল (রহঃ) ছিলেন যেমন বিখ্যাত সাধক ও ধর্মপ্রচারক, অপরদিকে ছিলেন তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী সমাজ সংস্কারক জনহিতৈষী মহাপুরুষ। এটাই ছিল তাঁর সব চেয়ে বড় পরিচয়। জনসেবা এবং সংস্কার কাজে তিনি নিজেকে এমনিভাবে বিলিয়ে দেন যে, তাঁর ব্যক্তিগত সুখ-শাস্তি, আরাম-আয়েশ একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন। কখন আহার করবেন, কখন বিশ্রাম করবেন, কোনটারই নির্দিষ্ট কোন সময় তার ছিল না। অধিক্তু রাত্রি জাগরণ করে করতেন ইবাদত-বন্দেগী। সংস্কারমূলক কর্মের মধ্যে প্রধানতম কর্মটি ছিল তার ধর্মনীতির সাথে সমাজ নীতি, অর্থনীতি, বিশেষতঃ রাজনীতির সমম্বয় সাধন। তিনি বিশ্বাস করতেন-ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান ব্যবস্থা, তাই জীবনের সর্বক্ষেত্রের চাহিদা ইসলাম পূরণ করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। আর এ আদর্শই ছিল হযরত রাসূলে করীম (স) ও খােলাফায়ে রাশেদীনের, তারই অনুসারী ছিলেন হযরত শাহ জালাল (রহঃ)।


হযরত শাহ জালাল (রহঃ) বিশ্বাস করতেন, পরকালের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য এ কাজই একমাত্র নির্ভর। বলা হয়, দুনিয়াই পরকালের শস্যক্ষেত্র। এখানে উৎপাদন প্রক্রিয়া হতে হবে ধর্মসম্মত, ইসলামী বিধান অনুযায়ী। আর সে বিধান হল হযরত মুহাম্মদ (স)-এর উপর অবতীর্ণ আল কুরআন। একই কারণে তিনি ইসলাম প্রচার ক্ষেত্রে কুরআন তথা রাসূলের অনুসৃত নীতি এর কোন পর্যায়ই বাদ দেন নি। তিনি ইসলাম প্রচারক শুধু নামায-রােজা, হজ্জ-যাকাত এবং জিকির-আজকার, ইবাদত বন্দেগীর মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখেন নি। তিনি ইসলামের নীতির সকল বিষয়ের প্রতিই কড়া ও সতর্ক দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতেন। তিনি সকল আদর্শ ও ধর্মীয় নীতির উপর সমান গুরুত্ব দান সহকারে ধর্ম প্রচার করতেন। এ জন্যই তাঁর দরবারে থাকত সর্বদা সর্বশ্রেণীর লােকদের অসম্ভব ভীড়। সামাজিক সালিস ব্যবস্থা হতে শুরু করে রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার কাজও তার দরবারেই চলত। তাঁর দ্বারা অনুষ্ঠিত এতগুলি কাজ পরিচালনা স্তুতে গিয়ে তাঁকে স্বীকার করতে হত অসম্ভব পরিশ্রম। এক ব্যক্তির পক্ষে এতগুলি কাজ দীর্ঘদিন অবিশ্রান্তভাবে চালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করা যায়। এজন্যই তিনি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। এমন অবস্থা চলাকালীনও হযরত শাহ জালাল (রহঃ) কর্তৃক ধর্মপ্রচার কার্যে নিয়োজিত দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁর খলিফাদের তরফ হতে স্থানীয় কোন অভিযোগ কিংবা অসুবিধার সংবাদ পেলে তিনি তখন হয় তাঁর আন্তানা হতে দূত মারফত সমাধান পাঠাতেন কিংবা নিজেই সরাসরি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন। তাঁর বিবাহের সময় এক মুহুর্তের সংবাদ আসে বুন্দাশীল নামে স্থান হতে। জিয়াউদ্দীন নামক জনৈক খলীফা ছিলেন ধর্ম প্রচার কার্যে নিয়ােজিত। বুন্দাশীল স্থানটি ছিল সুরমা ও বরাক নদীর মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। এ স্থানের লােকদের পানির নিদারুণ কষ্টের সংবাদ এসে পৌঁছল হত শাহ জালাল (রহঃ)-এর দরবারে।


সংবাদ নিয়ে এসেছিলেন সেখানে নিয়ােজিত খলিফা জিয়াউদ্দীন স্বয়ং। ব্যাপারটি ছিল-সুরমা ও বরাক নদীর মধ্যবর্তী এই বুন্দাশীল অঞ্চলটিকে পানির জন্য খনন ক্স কোন কূপই কার্যকরী হয় না। উভয় নদীর লবণাক্ত পানির কারণে কূপের পানি ব্যবহারের অযোগ্য। 

খলিফা জিয়াউদ্দীনের মুখে স্থানীয় লােকদের পানির অভাবের এহেন দুর্দশার সংবাদ পেয়ে হত শাহ জালাল (রহঃ) আর বসে থাকতে পারলেন না। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে তিনি জনাব জিয়াউদ্দীনকে সাথে নিয়ে গমন করলেন বুন্দাশীল। বুন্দাশীলে গিয়েই তিনি উভয় নদীতে তাঁর পবিত্র হয় ডুবিয়ে আল্লাহর মহান দরবারে দোয়া ও মুনাজাত করলেন। দেখতে দেখতে নদীদ্বয়ের পানির লবণাক্ততা চিরদিনের জন্য অবসান হয়ে গেল এবং পানি হয়ে গেল সম্পূর্ণরূপে মিষ্টি। 

অতঃপর কিছুদিন বুন্দাশীল অবস্থান করে স্থানীয় লােকদেরকে অমূল্য উপদেশ ও নছীহত প্রদান করে নিজ আস্তানা সিলেটে ফিরে আসলেন। তখন তাঁর স্বাস্থ্য খুবই ভেঙ্গে পড়েছিল, তিনি অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়লেন।



কারামতি জায়নামাযঃ হযরত শাহজালাল (রহঃ)-এর হরিণ চর্মের একখানা জায়নামাজ ছিল। জায়নামার্যখানা কেরামতি বলে লােকের ধারণা। কথিত আছে, হরত শাহ জালাল (রহঃ) মুসলিম বাহিনী নিয়ে যখন গৌড়ের রাজা গােবিন্দকে শাস্তি দিতে আসছিলেন। তখন সুরমা নদী পার হয়েছিলেন উক্ত জায়নামায দাঁড়িয়ে। সেনাবাহিনী ছিল তাঁর পিছনে। সে জায়নামাযের অবস্থা বর্তমানে জীর্ণ। হয়তাে কালে একদিন তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যবে।

শ্ৰীহট্টে আমগনকালে হযরত শাহ জালাল (রহঃ) উট পাখির দুটি ডিম নিয়ে আগমন করেছিলেন। তাও কারামতি ডিম বলে কথিত। তাদের একটির সন্ধান কেউ জানে না, অন্যটি এখনও তাঁর দরগাহে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত আছে। অনুরূপ হযরত শাহ জালাল (রহঃ) প্রয়ােজনমত একটি নির্দিষ্ট পাথরে তায়াম্মুম করতেন, সে পাথরখানাও মাজার সংলগ্ন রক্ষিত রয়েছে। পাথরখানা হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এর হাতের ছাপ আছে বলে অনুমিত হয়। তা একটি কারামতি পাথর।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে